যশোরের এক গ্রামে ‘সাপের কামড়ে’ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসছেন রোগীরা। অসুস্থদের দাবি, ‘জিন সাপে তাদের কামড়েছে।’ গত এক সপ্তাহে অজানা এই সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ৩০ ব্যক্তি। এর মধ্যে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১০ জন। বাকিরা স্থানীয় ওঝা ও কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন।
তবে চিকিৎসকরা বলছেন, তারা মানসিক আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যশোরের চৌগাছা উপজেলার রাণীয়ালি গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।
সোমবার (৮ জুলাই) বিকেলে স্থানীয় পাশাপোল ইউনিয়নের ইউপি সদস্য গোবিন্দ চন্দ্র ঢালী জানান, ‘ বুধবার (৯ জুলাই) রাতে সাপে দংশনের শিকার হন রাণিয়ালি গ্রামের আব্দুর হকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম। যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন রাবেয়ার মৃত্যু হয়। তারপর থেকে এলাকায় সাপ আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অনেকেই সাপে কামড়েছে দাবি করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু কেউ সাপ দেখেনি। শরীরে জ্বালাপোড়া আর জ্ঞান হারানো ঘটনা ঘটলেই ওঝা কবিরাজদের কাছে যাচ্ছেন। ওঝারা শরীরে বিষের উপস্থিতি নিশ্চিত করলেই কেউ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, কেউবা স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক ও কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত গ্রামটিতে ৩০ জন এতে আক্রান্ত হয়েছেন। ১০ জনের মতো যশোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’
আরো পড়ুন=>> বেনাপোলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৬ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয়
যশোর জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের রানিয়ালি গ্রাম থেকে রোববার ও সোমবার ১০ জন রোগী কোনো কিছুর দংশনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে নারী ৮ জন ও দুই জন পুরুষ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এই ব্যক্তিদের কারো কারো হাত ও পায়ে লাল দাগ আবার দাগ ছাড়াও কেউ কেউ ভর্তি হয়েছেন। ১০ জনকেই ভর্তি রেখে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছেন। সাপে কামড়ানোর তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। তাই অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশন দেওয়া হয়নি তাদের।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রাণিয়ালি পশ্চিমপাড়ার মিথুন মন্ডলের স্ত্রী প্রান্ত মন্ডল (৩৩) বলেন, ‘গতকাল সকালে রান্নাঘরের শুকনা কাঠ সাজাচ্ছিলাম। এ সময় হাতে কিছু একটা কামড় দিলে জ্বলে ওঠে। হাতের ডান হাতের কবজিতে লাল দাগ সৃষ্টি হয়। বাড়ির লোকজনের পরামর্শে স্থানীয় ওঝার কাছে গেলে তিনি আমার শরীরে বিষের উপস্থিতি আছে বলে জানান। এরপর রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।’
রাণীয়ালি হাইস্কুল পাড়া এলাকার উৎপল মন্ডলের স্ত্রী তমালিকা (২২) বলেন, ‘রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে দেখি হাতে জ্বলছে। এক পর্যায়ে হাত অবশ হয়ে যায়। সেখানে কিছু একটা কামড়ের দাগ রয়েছে। ওঝার কাছে গেলে বিষের উপস্থিতি আছে বললে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখন অনেকটা সুস্থ রয়েছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘কয়েকদিন আগে একজন মারা যাওয়ার পর থেকে সাপ আতঙ্কে রয়েছি আমরা। কিন্তু সাপ দেখেনি কেউ। কবিরাজ ওঝার কাছে গেলে তারা বলছে, জিন সাপে কেটেছে। জিন সাপ তার নাতনির পায়ে কামড়ায়। এরপর ঝিকরগাছার বাঁকড়া ওঝার কাছে নিয়ে গেলে ঝাড়ফুঁক করেছেন। চার হাজার টাকার বিনিময়ে ওঝার থেকে ঝাড়ফুঁক নেন। কিছুটা সুস্থ হলেও স্থানীয়দের পরামর্শে নাতনিকে হাসপাতালে এনেছি।’
তিনি দাবি করেন, ‘তাদের পরিবারের একজনসহ গত এক সপ্তাহে রাণিয়ালি গ্রামে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষকে জিন সাপ কামড়েছে।’
আরো পড়ুন=>> দুর্নীতি প্রতিরোধে বাবাকে ‘টিকা’ দিন: টিআইবি
যশোর জেনারেল হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র নার্স শিউলি সরকার বলেন, ‘মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে বর্তমানে ৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তারা বলছেন, তাদের সাপে কেটেছে। তবে সাপে কাটার তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। তাদের ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তারা সবাই সুস্থ রয়েছেন।’
এদিকে গ্রামের বেশ কয়েকজন জানান, সাপে কাটার কথা শোনা গেলেও কেউ এখনো সেই সাপ দেখেননি। কবিরাজ-ওঝারা বলছেন, এটি জিন সাপ। গ্রামের সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাসও করছেন। তাই গ্রামবাসীর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অনেকেই স্থানীয় ওঝা কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন। জিন সাপ আতঙ্কের সুযোগ নিয়েছেন স্থানীয় ওঝা, সাপুড়ে, কবিরাজরাও। জিন সাপে দংশিত হচ্ছে মানুষ- এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে তারা লুটে নিচ্ছে জনসাধারণের অর্থ।
যশোর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার আবু হায়দার মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘কোনো রোগীকে সাপে কামড় দেয়নি। সকলেই আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেডিকেলের ভাষায় এই রোগকে বলা হয় ‘ম্যাসহিস্ট্রিরিয়া ইলনেস’। এটি মূলত মানুষের নিউরো হরমোন ও মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে হয়ে থাকে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, অনেকেই আতঙ্কে ভর্তি হচ্ছেন। ভর্তি রোগীরা সবাই সুস্থ রয়েছেন।
তিনি বলেন, মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। বাড়িঘরের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে। কোনো সাপ কামড়ালে সরাসরি হাসপাতালে চলে আসা উচিত। এছাড়া সাপে কামড়ালে সেটির ছবি তুলে রাখতে পারলে চিকিৎসা দেওয়া অনেকটাই সহজ হয়। হাসপাতালে এন্টিভেনমের কোনো সংকট নেই।