এক সময় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় ব্যাপক পাট উৎপাদন হতো। কিন্ত গত কয়েক বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় জলাশয়ের অভাব, দামের সমস্যা এবং উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কারণে দিনদিন পাটচাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা।
গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে অর্থকরী এ ফসলটির চাষ অর্ধেকে নেমে এসেছে। কৃষকেরা বলছেন, পাট পচাতে কৃষি অফিস যে রিবরণ রেটিং পদ্ধতির কথা বলছে তা অনুসরণ করলে পাটের রঙ নষ্ট হয়ে যায় এবং দাম কমে যায়।
তারা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে নদী, খাল, বিলসহ জলাশয়গুলো খননের মাধ্যমেই কেবল সোনালী আঁশের দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্ষার ভরা মৌসুমেও ঠিকমত বৃষ্টিপাত হয় না। ফলে জলাশয়গুলোতে পানি থাকে না। ফলে পাট পচানোর উপযুক্ত পানি না থাকায় কৃষকেরা পড়ছেন বিপাকে। বাধ্য হয়ে নিচু জমি ভাড়া নিয়ে স্যালোমেশিনের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করে হাঁটু পানিতে পাট পঁচাচ্ছেন তারা। এতে একদিকে তাদের উৎপাদন ব্যয় যেমন বেড়ে যায়, তেমনি পাটের রং ও আকর্ষণীয় হয় না।
আবার একে একে পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতেও প্রভাব পড়েছে পাটের বাজারে। সিন্ডিকেটের কারণে দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। এমন অবস্থায় পাট কিনে লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় পাট ব্যবসায়ীদের। তাদের অধিকাংশই আজ পাটের ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
আরো পড়ুন=>> মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে মাদকসহ আটক ৩
যে কারণে ধারদেনা করে পাটচাষ করার পর পাটের ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না কৃষকেরা। এই পরিস্থিতিতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন স্থানীয় ক্রেতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা। তারা যে দাম বলছেন, তাতেই নিজেদের উৎপাদিত পাট ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ মৌসুমে ঝিনাইদহ জেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার ৭০০ হেক্টর ধরা হলেও চাষ হয়েছিল ২২ হাজার ৫২৪ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলায় ১ হাজার ৫৫০ হেক্টর, ঝিনাইদহ সদরে ৫ হাজার ৭২ হেক্টর, কোটচাঁদপুরে ৬৩৫ হেক্টর, মহেশপুরে ৪ হাজার ২৭৫ হেক্টর, শৈলকুপায় ৮ হাজার ৪২৫ হেক্টর এবং হরিণাকুণ্ডুতে ২ হাজার ৫৬৭ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়।
আর চলতি ২০২৪-২০২৫ মৌসুমে জেলায় পাট চাষের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৩ হাজার ৮০০ হেক্টর। কিন্তু চাষ হয়েছে ২১ হাজার ৪৪৬ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ, এ মৌসুমে পাটচাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৩৫৪ হেক্টর কমে গেছে।
এর মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলায় চাষ হয়েছে গত মৌসুমের অর্ধেকেরও কম মাত্র ৭১০ হেক্টর, মহেশপুরে ৪ হাজার ৭০ হেক্টর, কোটচাঁদপুরে ৪১৫ হেক্টর, শৈলকুপায় ৮ হাজার ৪৭৭ হেক্টর, হরিণাকুণ্ডুতে ২ হাজার ৭১২ হেক্টর এবং ঝিনাইদহ সদরে ৫ হাজার ৬২ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। তবে নিচু এলাকা, নদী ও জলাশয় থাকায় জেলার মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক পাট চাষই হয়েছে শৈলকুপা উপজেলাতে।
কৃষকরা জানান, আগে বীজ বপন থেকে পাট সংগ্রহ পর্যন্ত বিঘাপ্রতি পাটে সাধারণত প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হতো। কিন্তু বর্তমানে সার, কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি, পাট পচানোর জন্য জায়গা কমে যাওয়ার কারণে খরচ আরও বেড়েছে। এ কারণে বিঘাপ্রতি ২২ থেকে ২৪ হাজার টাকাতেও কুলাচ্ছে না।
কালীগঞ্জ উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক মাহাবুবুর রহমান জানান, তাদের গ্রামের উত্তর মাঠে তারা দুই ভাই শুধু মোট ৪ বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছেন। আর কেউ করেননি। অথচ এক সময় পুরো মাঠেই পাটের চাষ হতো। পাট পচানোর সুযোগ না থাকাতেই এমনটি হয়েছে বলেন মাহাবুবুর।
বলরামপুর গ্রামের পাটচাষী দুদু মিয়া জানান, দিন দিন সার-কীটনাশকসহ কৃষি উপকরনের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বীজবপন থেকে পাট ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রায় ৫ মাস সময় লেগে যায়। ভালো পাট হলে প্রতিবিঘা ২০ থেকে ২৫ মন পাট পাওয়া যায়। দাম ভালো থাকলে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার ওপরে লাভ থাকে। কিন্তু সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণ না করায় সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দাম পড়ে যাচ্ছে পাটের।
কালীগঞ্জ কামালহাট গ্রামের পাটচাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, গত বছর দুই বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছিলেন। এবার ১ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। পাটের তুলনায় অন্য সবজি চাষে লাভ বেশি হচ্ছে। এজন্য পাট চাষ কমিয়ে দিয়েছেন। খালে-বিলে পানি না থাকায় স্যালোমেশিনে সেচ দিয়েই পাট পচাতে হবে তার।
পাট ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, পাটের বাজার একেক সময় একেক রকম থাকে। সরকারি মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেসরকারি মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে পাটের দাম নির্ধারণ করে। এতে ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাছাড়া পাট চাষীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনি জানান, এ এলাকার মাটি পাটচাষের জন্য উপযোগী। এক সময় রেকর্ড পরিমান পাটচাষ হতো। কিন্ত সম্প্রতি বর্ষা মৌসুমেও তেমন ভারী বৃষ্টি হয় না। ফলে নদী, খাল বিল ও জলাশয়ে পানি না থাকায় পাট পচাতে বেগ পেতে হয় কৃষকদের। সে কারণে কৃষকেরা পাটচাষ কমিয়ে দিয়েছেন। এখনও এলাকার জলাশয়ে পানি জমেনি। ফলে পাট পচাতে রিবণ রেটিং পদ্ধতিরই পরামর্শ দিলেন তিনি।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, শিলাবৃষ্টি ও বৈরি আবহাওয়ার কারণে পাটের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পাট পচাতে বেগ পেতে হচ্ছে চাষিদের। কিন্তু প্রকৃতিতে কারও হাত নেই।