দালালচক্রের সদস্যরাসহ টাকার ভাগ পান পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক বলেও অভিযোগ উঠেছে
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনার জয়নগর আন্তর্জাতিক চেকপোস্টে দালালদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ভারত-বাংলাদেশে যাতায়াতকারী যাত্রীরা। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, রাজবাড়ী, মাগুরা ফরিদপুর, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ এই চেকপোস্ট দিয়ে যাতায়াত করেন। তারাই মূলত দালালচক্র দারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে।
এছাড়া ইমিগ্রেশন সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নামে দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্টধারী যাত্রীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ইনচার্জ এসআই আতিকুর রহমানের আতিকসহ ইমিগ্রেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তারা বিরুদ্ধে। আর এসব টাকা আদায়ে পুলিশ সদস্য, কাস্টমসের কয়েকজন সদস্য ও দালালচক্র সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
আরো পড়ুন=>> নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে সদর হাসপাতালের চিকিৎসা
আরও অভিযোগ রয়েছে যে, ভারত-বাংলাদেশে যাতায়াতকারী প্রতিজন যাত্রীর কাছ থেকে দালালচক্রের সদস্যরা বিভিন্ন কৌশল এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০০-২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে। আর কোনো যাত্রী টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে চেকপোস্টের ইনচার্জসহ ইমিগ্রেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দ্বারা তার পাসপোর্ট আটকিয়ে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করে থাকে দালালচক্রের সদস্যরা।
এছাড়া ভারত ফেরৎ যাত্রীদের কাছ থেকে মালামাল ছিনিয়ে নেওয়ারও অভিযোগও রয়েছে। এক কথায় দর্শনা আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট বর্তমানে দালালচক্রের কাছে একেবারে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, চিকিৎসা, ভ্রমণ, ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে বর্তমানে প্রতিদিন ৮শ থেকে ১ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন এ স্থলপথ দিয়ে। যারফলে এখানে যাত্রীদের চাপ থাকে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দালালচক্রের সদস্যরা ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার নাম করে যাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। আর যেসব যাত্রী টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন তাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশ থেকে ভারত ও ভারত থেকে বাংলাদেশে যাওয়াআসা করা যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গড়ে দৈনিক ৮০০ থেকে এক হাজার ভারত-বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী যাত্রী এ ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করেন। আর বৈধভাবে দু-দেশে আসা যাওয়া করা প্রত্যেক যাত্রীকেই গুনতে হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। কোন কোন ক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় এক-দেড় হাজারে। দালালদের টাকা দিতে না চাইলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হতে হয় অনেকেরই।
সেই হিসেব অনুযায়ী দৈনিক অন্তত এক লক্ষ টাকার বেশি অবৈধ বাণিজ্য হয় এ চেকপোস্টে। এর মধ্যে সিংহভাগ টাকা যায় ইনচার্জ এসআই আতিকসহ অন্য কর্মকর্তার পকেটে। এছাড়া এখান দিয়ে দৈনিক কোটি কোটি টাকার হুন্ডি হবার অভিযোগও নতুন নয়।
আগমন ও বহির্গমণ যাত্রীদের তথ্য প্রদান ও সহায়তার জন্য ইমিগ্রেশনে আছে হেল্পডেস্ক। এখানে নির্দিষ্ট একটি ফরম পূরণ করতে হয় আগমন ও বহির্গমণ যাত্রীদের। নিয়ম অনুযায়ী সেখানে কয়েকজন পুলিশ সদস্য দায়িত্বপালন করেন। আর দালালদের সহায়তায় এই হেল্পডেস্কে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমেই টাকার লেনদেন হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ভারতে যাওয়া ও ভারত থেকে দেশে ফেরা যাত্রীরা কাস্টমস চেকপোস্ট ভবনের সামনে আসলেই ঘিরে ধরেন তালিকাভূক্ত দালালেরা। স্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ যাত্রীরা দালাল ছাড়া কোনোভাবেই ফরম পূরণ করতে পারেন না।
কৌশলে দালালেরা যাত্রীদের নির্দিষ্ট ফরম পূরণে সহায়তার ও কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনের কাজ দ্রুত সম্পাদনের কথা বলে যাত্রীদের হেল্পডেস্কের পাশে বসিয়ে হাতিয়ে নেয় টাকা। দালালদের মাধ্যমে এসব টাকা চলে যায় সেখানে থাকা পুলিশ সদস্য মামুনসহ অন্যদের হাতে। এরপর কর্মদিবস শেষে এসব টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয় নানাখাতে।
সুত্র বলছে, এসআই আতিক জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জের দায়িত্বে আসার পরে এখানে দালালদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর দালাল সিন্ডিকেটও হয়েছে আরও শক্তিশালী। এছাড়া তিনি আরও বলেন, শুধু ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জ টাকা নেয় এটাই দেখলেন। এখান দিয়ে দৈনিক কোটি কোটি টাকার হুন্ডি হয়।
সেটা কি জানেন আপনি? হুন্ডি কি থামাতে পারবেন? শুধু আমি দালাল মুক্ত করার কথা বললে তো হবে না। তারা এখানে কর্ম করে খাচ্ছে। এখানকার অনেক মানুষের রুটি রুজি হয় ওই টাকায়। আমি কি ভাবে তাদের পেটে লাথি দেব? এক বছর হয়ে গেছে আমি আছি। শিগগিরই আমি এখান থেকে চলে যাবো। তবে নিউজ করে মানুষের ক্ষতি কইরেন না। পারলে উপকার করবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দালাল জানান, পাসপোর্টধারী সকল যাত্রীদের টাকা গুনতে হয়। ফরম পূরণ করতে হলে টাকা দিতেই হবে। এটা এসআই আতিকের নির্দেই হয়। সবার কাছে থেকে একটি নির্দিষ্ট টাকা নয়, যার কাছ থেকে যেমন পাওয়া যায় নেওয়া হয়। সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা নিই। এর মধ্যে আতিক স্যার নেন, আমরাই পাই। হিসেব মতো আমাদের মাধ্যমে দৈনিক অন্তত একলাখ টাকার বেশি আয় হয়।
ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাংলাদেশে ফেরা গোপেন বিশ্বাস নামক এক পাসপোর্টধারী যাত্রী বলেন, আমার কাছ থেকে ইমিগ্রেশনে ফরম পূরণ বাবদ ১৫০ টাকা নিলো দালাল। এই টাকা নাকি সবাইকেই দিতে হয়। নাহলে হয়রানি করে। আমি ভারত থেকে অবৈধ কিছুই আনিনি তারপরও টাকা দিতে হলো। কিছুই করার নেই। হয়রানি এড়াতে নিরুপায় হয়ে দিলাম টাকা।
এমন অভিযোগ শুধু গোপেন বিশ্বাসেরই নয়। নাম প্রকাশ না করা বহির্গমণ বা আগমন বেশিরভাগ সকল যাত্রীদেরই একই অভিযোগ। তাদের দাবী এখানে দেখার কেউ নেই। ইমিগ্রেশনের পুলিশ যা ইচ্ছা তাই করে। টাকা না দিলে হেনস্তা করে নানাভাবে।
এছাড়া এসআই আতিকের অফিসের সামনে যেতেই দেখা যায় তার কক্ষের মধ্যে অবস্থান করছে অন্তত ৫/৭ জন দালাল। এসময় তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরা সবাই আমার লোক। তারা পুলিশ সদস্য কি না জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরেবর্তীতে আবারও জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরা সবাই এখানে কাজ করে। তবে পুলিশ সদস্য না হয়েও তার অফিস কক্ষে তাদের কি কাজ এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ইমিগ্রেশন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
দালালদের মাধ্যমে যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন জয়নগর আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জ এসআই আতিকুর রহমান। পরে তথ্য-প্রমাণাদির কথা শক্তভাবে বলেন এসআই আতিক বলেন, এটা নতুন কিছু না।
আমার জানামতে ইমিগ্রেশন চালু হওয়ার পর থেকে এই রীতি চালু আছে। আমার আগে যারা এখানকার ইনচার্জের দায়িত্বপালন করেছেন সবাই এ কাজ করেছেন। কারণ এখানে থাকতে হলে টাকা নিতেই হবে। না হলে একমাসও এখানে চাকরি করা যাবে না। বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে।
তিনি বলেন, দৈনিক লাখ টাকার বাণিজ্যের তথ্যটা সত্য নয়। যাত্রীদের এক তৃতীয়াংশ অসুস্থ, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী যাতায়াত করে। তাছাড়া শিশু যাত্রীও আছে। তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়া হয় না। তাছাড়া এই টাকা আমি একলা ভোগ করিনা। এই টাকার ভাগ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ নেন বলে জানি। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকরাও তো টাকা নেন।
দালাল সিন্ডিকেটের ব্যাপারে এসআই আতিক বলেন, আমার কোনো দালাল সিন্ডিকেট নেই। আর এখানে যাদের দেখছেন সবাই এই ইমিগ্রেশনের জন্মলগ্ন থেকে কাজ করে। আমি তাদের দালাল বলবো না, বরং তারা যাত্রীদের সহায়তা করে টাকা নেন বলে আমি জানি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) নাজিম উদ্দীন আল আজাদ (পিপিএম) বলেন, আপনি যে তথ্য জানতে চাইলেন, বিষয়টি আমার অজানা। আপনার মাধ্যমে অনেক তথ্য জানলাম। এ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগীতা চাই। বিষয়টি তদন্ত করা হবে। ঘটনার সত্যতা পেলে ওই পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
দালাল নির্মূলের ব্যাপারে জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তের ৮ কিলোমিটার বিজিবির নিয়ন্ত্রণে। আমদের লোক ওখানে গেলে বিজিবিকে জানিয়ে যেতে হয়। দেখা গেলো আমরা সেখানে যাচ্ছি, দালাল সব পালিয়ে গেছে। বিজিবি এ্যাকশন নিলেই ইমিগ্রেশন এলাকা দালালমুক্ত হবে।