চরম বিপাকে ২০ হাজার হেক্টর জমির কৃষক

জিকে সেচ প্রকল্পের পাম্প অকেজো হওয়ায় চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ চার জেলায় ধান উৎপাদন ব্যাহত

নিজস্ব প্রতিবেদক: কুষ্টিয়া, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলার কৃষকদের বৃহৎ একটি অংশ জিকের সেচ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তবে বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষের (জিকে) কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার তিনটি সেচ পাম্পই অকেজো হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে পানি সরবরাহ। এর ফলে চলতি বোরো মৌসুমে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার সেচ প্রকল্পাধীন এলাকার ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে।

এতে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। সেই সাথে চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত দেড় লাখ টন ধান উৎপাদন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কৃষকেরা সেচ প্রকল্পের পানি কবে পাবেন তার কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে পানিশূন্যতায় মাঠের পর মাঠ ফেটে চৌচির। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে খাদ্য শস্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি এসব কৃষক পরিবার জীবন ধারণে সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানের দাবি করছে চাষিরা। তারা সেচ সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় নিজেদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে সেচ সরবরাহ চালুর দাবি করেছেন।

এ দিকে, সেচ প্রকল্প মেরামত ও বিকল্প ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সমাধানের কথা জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের পরামর্শ কৃষি বিভাগের। যদিও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে। সেচ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পদ্মায় পানির স্তর স্বাভাবিক থাকলে একেকটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ২৮ হাজার ৩১৬ দশমিক ৮৫ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। মোট তিনটি পাম্পের মধ্যে ৩ ও ২ নম্বর পাম্প দু’টি গত ২০১৭ ও ২০২১ সাল থেকে অকেজো। ১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে চ্যানেলের মাধ্যমে পানি এনে পাম্প করে খালের মাধ্যমে চার জেলার ১৩টি উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় সেচযোগ্য এলাকা রয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ১০৭ হেক্টর। শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা তিনটি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ।

সূত্রে আরো জানা গেছে, এই প্রকল্পে ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খাল রয়েছে। এসব খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরার কৃষকরা ব্যবহার করে চাষাবাদ করতেন। সেচ প্রকল্পের পানি না পেয়ে বর্তমানে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচবাবদ প্রতি বিঘায় খরচ বেড়েছে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। স্বল্প খরচের সেচব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ৩০ থেকে ৩৫ গুণ বেশি খরচ করে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে বিভিন্ন ফসলের জমিতে সেচ দিচ্ছেন অনেক কৃষক।


এ দিকে, সেচ প্রকল্পের খালে পানি থাকলে সেচের পাশাপাশি আশপাশের নলকূপ ও পুকুরে পানি স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে নলকূপে পানি পাওয়া নাও যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যার নমুনা ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারিতে ১ নম্বর পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়। কিন্তু ১৯ দিন পরে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও অকেজো হয়ে গেছে। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারছেন না, কারো ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন।


কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের পাম্প ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, ‘দু’টি পাম্প আগে থেকেই নষ্ট ছিল। তৃতীয় পাম্প দিয়ে ১ জানুয়ারি ক্যানেলে পানি সরবরাহ শুরু হয়। কারিগরি ত্রুটির মুখে ১৯ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় পাম্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মেনটেন্যান্স বাবদ প্রতি বছর ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়। গত বছর ৫৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’
অত্র প্রকল্পের উপ-প্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, ‘এই সময়ে পদ্মায় পানি কম থাকায় বর্তমানে পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ পাম্প চালু হবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না।’


বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রশিদুর রহামান আজকের খাসখবরকে জানান, ‘দেশের বৃহৎ এই সেচ প্রকল্পটি মেরামত ও পুনর্র্নিমাণ করে চালু করতে প্রকল্প গ্রহণ ও প্ল্যানিং কমিশনে প্রেরণ করা হয়েছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে।’ একইসাথে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান সেচ সঙ্কট থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও ভাবছে সরকার। বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় ৯৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব ছিল। দু’টি মেশিন আগে থেকে নষ্ট থাকায় চলতি বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার সক্ষমতা ছিল প্রকল্পের। অবশেষে শেষ পাম্পটি নষ্ট হওয়ায় এবার সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হলো না।’ কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জোতমোড়া গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন ও আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘সেচখালে পানি না থাকায় চারা দিতে পারছি না। পেঁয়াজ আবাদের পর ওই জমিতে প্রতি বছর ধান আবাদ করা হলেও এবার হয় তো আর ধান আবাদ হবে না। ভুট্টা রোপনের সময়ও শেষ।’ সদর উপজেলার জগতি গ্রামের চাষি শমসের আলীর অভিযোগ, ‘খালে পানি না আসায় চাষাবাদে চরম সমস্যায় আছি। শ্যালোতে পানি উঠছে না যে দু’একটিতে একটু উঠছে তাও হাফ পরিমাণ। জমি পতিত থাকলে ক্ষতি হবে।’ চাষি বাবুল হোসেন বলেন, ‘পানি ছাড়া কোনো ফসলই হচ্ছে না, জিকে কর্তৃপক্ষ আগে যদি জানাতো পানি দিতে পারবে না, তাহলে আমরা আগেই অন্য ব্যবস্থা করতাম।’


খোকসা উপজেলার কৃষক আরমান শেখ জানান, ‘পানির আশায় থেকে অন্য ফসল আবাদ করিনি। আবার ধানও রোপণ করতে পারলাম না এই কৃষকেরা খালে পানি সরবরাহের জোর দাবি করেন।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক সুফি রফিকুজ্জামান জানান, ‘চলতি বোরো মৌসুমে জেলাতে ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ বছর জিকে সেচ প্রকল্পের সেচ সরবরাহ বন্ধ থাকায় সেচ এলাকাধীন ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে ৭৭ হাজার টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঘাটতির শঙ্কা থাকবে প্রবল।

তবে পরে আমন মৌসুমে এই ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার কথা জানালেন তিনি।’ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার সেচ সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল মতিন জানান, ‘বোরো মৌসুমে কুষ্টিয়াসহ চার জেলার সেচ সরবরাহ আওতাধীন ৯৫ হাজার ৬১৬ হেক্টর জমির মধ্যে ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এ বছর উল্লেখিত ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করতে চাইলে চাষিদেরই অন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।’ বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষের (জিকে) ভেড়ামারার ফাইল বন্দী প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদন এখন সময়ের দাবি। প্রকল্প বাস্তবায়নই এই সঙ্কট মোকাবেলার একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী চার জেলার কয়েক হাজার কৃষক।