আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাচনে চলিতেছে যাত্রাপালা…

চাচা-ভাস্তের বিরোধের ছায়ায় ভোটের মাঠে বেকায়দায় মঞ্জিলুর-নুরুল

দিলীপের স্পষ্ট অবস্থানে জিল্লুর কোর্টে বল, জিপুকে নিয়ে মধ্যমাঠে আয়ুব

সারাদেশের সাথে আলমডাঙ্গাতেও আগামী ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে যষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন ঘিরে পুরো জেলাজুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও গত ৮ মে দামুড়হুদা ও জীবননগর উপজেলার ভোট শেষ হবার পর, আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু এখন চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাচন ঘিরে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাচনে শুরু থেকে চলিতেছে সার্কাস। এনিয়ে আজকের খাসখবর পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। তবে এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আলমডাঙ্গায় শুরু হয়েছে রীতিমতো যাত্রাপালা। কে কার? এখানে বোঝা বড় দ্বায় হয়ে যাচ্ছে। এই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা বেশকিছু দল নির্বাচনে না আসায় ভোটের মাঠে উৎসব না থাকলেও প্রতিটি প্রার্থীর নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘চলিতেছে যাত্রাপালা’ এর মতো অবস্থা। যদিও প্রথম থেকেই প্রার্থীরা তাদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ভোটের হাওয়ায় উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটা মূলত শুরুই করেছেন চলতি মেয়াদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন আবারও প্রার্থী হয়ে। সবাই ভেবেছিলেন বয়সের কারণে এবার তিনি ভোটে থাকবেন না। তবে শেষ মুহূর্তে দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়ে, সবার সেই ভাবনায় ছেদ ফেলেছেন। কিন্তু সবার ভাবনায় ছেদ পড়লেও এবার যে গত বারের মতো কাগুজে নৌকার তকমা দিয়ে কাউকে সহজে পরাজিত করে আবার চেয়ারে বসা যাবে না, সেটা মাঠে নেমেই টের পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন। প্রমাণ স্বরুপ বলা যায়- সম্প্রতি কুলপালা নামক স্থানে গণসংযোগে যেয়ে স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে নিজের কর্মীদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে বিব্রতকর অবস্থায় মধ্যে পড়েন তিনি। যদিও তিনি পরবর্তীতে এটাকে বিরোধীদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে সব শেষ চেষ্টা হিসেবে আলোচিত সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাবেক মেয়র জিপু চৌধুরীকে দলে ভিড়িয়ে ভোটের মধ্যমাঠ গরম করার কাজ এখনো অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাচনের শুরু থেকেই ভোটের মাঠে সরব ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক সাবেক চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান সব হিসেব-নিকেশের ফল নিজের ঘরে রেখেছেন। জিল্লুর রহমান গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়েও হেরে ছিলেন। তবে এবার শুরু থেকেই ভোটের মাঠে বল রেখেছেন নিজের কোর্টে। সবশেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চুয়াডাঙ্গার রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালা প্রকাশ্যে জিল্লুর রহমানকে সমর্থন করায় তার ভোটের মাঠ শক্ত হয়েছে তার। যদিও প্রথম দিকে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা নিশ্চুপ ছিলেন। কারণ বর্তমান চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন ও জিল্লুর রহমান দুজনই ছিলেন তার পক্ষের লোক। তবে আইয়ুব হোসেন জিপু চৌধুরীকে দলে ভেড়ালে এর কয়েকদিন পরেই দিলীপ কুমার আগরওয়ালা জিল্লুর রহমানকে সমর্থন দিয়ে নিজের রাজনৈতিক নীরবতা ভাঙ্গেন। এছাড়া উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা থাকায় জিল্লুর রহমানের ঘোড়ার দৌড়ের গতিও অন্য সবার চেয়ে একটু বেশি বলেও সরেজমিনে উঠে এসেছে। তবে আর্থিক দুর্বলতা তাকে বেশ ভোগাবে বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।


এদিকে, আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ঢাকার ব্যবসায়ী কে এম মঞ্জিলুর রহমান। মোটরসাকেল প্রতীক তার। অন্য প্রার্থীদের তুলনায় হেভিওয়েট না হয়েও তিনি কোনা এক অদৃশ্য কারণে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন মিয়ার সমর্থন পেয়েছেন। যার ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনেকটা প্রকাশ্যেই তার পক্ষে প্রচারণায় নেমেছেন। সে কারণে প্রচারণায় তিনি রাজনৈতিক সুবিধাও বেশ পাচ্ছেন। তবে জিল্লুর রহমান ও নুরুল ইসলামকে ছাপিয়ে ভোটের মাঠ দখলে নেওয়া তার পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তাও ইতিমধ্যে তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তবে অসমর্থিত বেশ কয়েকটি সূত্রের দাবি, ব্যবসায়ী মঞ্জিলুর রহমান নাকি কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বেশকিছু রাজনৈতিক নেতাদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেছেন। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এবিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ প্রতিবেদকের হাতে আসেনি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেককেই বলতে শোনা গেছে- ঢাকার ব্যবসায়ী মঞ্জিলুর রহমান ভোটের মাঠে অনেকটা যাত্রাপালার শিল্পীদের ভুমিকায় আছেন, জয়-পরাজয় যাই হোক, তার পারফর্ম করা তো হলো!


অন্যদিকে, হারদী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম কাপ-পিরিচ প্রতীক পেয়ে প্রকাশ্যে যুবলীগ নেতৃবৃন্দের সমর্থন নিয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন। সম্প্রতি জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার আনুষ্ঠানিকভাবে নুরুল ইসলামকে সমর্থন দিয়েছেন। যদিও যুবলীগ নেতাদের এখনও তেমন ভাবে প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা যায়নি। তবে হারদী গ্রামকে শিক্ষানগরীর মর্যাদার পেছনে অবদানের কারণে অত্র ইউনিয়নে তার সুখ্যাতি রয়েছে। এছাড়া হারদী ইউনিয়নের দু’বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হওয়ায় উপজেলাজুড়ে তার পরিচিতিও রয়েছে। তবে আলমডাঙ্গা হলেও সেখানে জেলার রাজনীতির প্রভাব পড়েছে। চাচা-ভাস্তের বিরোধ আলমডাঙ্গাতেও এখন বিদ্যমান। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন মিয়া ঢাকার ব্যবসায়ী মঞ্জিলুর রহমানকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেবার পরই, নিজের নির্বাচনী প্রচারণা ফেলে নুরুল ইসলামকে সমর্থন দেন জেলা যুবলীগের আহবায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার। মূলত ভোটের যাত্রাপালা এখান থেকেই জমতে শুরু করে এবং চাচা-ভাস্তের বিরোধ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা ছাপিয়ে প্রকাশ্যে আসে আলমডাঙ্গাতেও। তবে এতো সবকিছুর মধ্যেই নির্বাচনের এই যাত্রাপালায় দৃষ্টি কাড়েন দীর্ঘ বছর ধরে ঢাকায় ব্যবসা করা আরেক প্রার্থী মোমিন চৌধুরী ডাবু। তিনি আনারস প্রতীক নিয়ে ভোটের শুরু থেকে মাঠে থাকলেও লোকবল ও যথেষ্ট পরিচিতির অভাবে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তিনি আলোচলায় এসেছেন অন্য কারণে। সম্প্রতি ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী জিল্লুর রহমানকে নিয়ে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা করা নির্বাচনী মতবিনিময় সভায় যোগ দেন আনারস প্রতীকের প্রার্থী মোমিন চৌধুরী ডাবু। এরপর ফেসবুকসহ সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। এনিয়ে ভোটের মাঠে তার অক্ষমতা রয়েছে বলে নানা প্রতিক্রিয়া জানান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। যা নিয়ে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েন তিনি। সবশেষে সাংবাদিকদের ডেকে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিলেও ভোটের মাঠে সেই তলানিতেই তার অবস্থান। স্থানীয় কিছু সাংবাদিক তাকে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও মূলত মোমিন চৌধুরী ডাবুর ভোটের মাঠ অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অন্য প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পর্যায়ে নেই বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে এই উপজেলা নির্বাচনে সব নেতাকর্মীরাই পড়েছেন ধন্দে। কে কখন কার পক্ষে কাজ করছেন, তা নির্ণয় করতেই সময় চলে যাচ্ছে। অনেকেই অনেকটা ব্যঙ্গ করে বলছেন- আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাচন তো নয়, যাত্রাপালার শিল্পিদের মতো প্রায় সব প্রার্থীরই পক্ষে লোকজন চিল্লিয়ে ভোটের মাঠ দখলের চেষ্টায় ব্যস্ত। এ যেন চলিতেছে গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া যাত্রাপালা।
উল্লেখ্য, আগামী ২১ মে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আলমডাঙ্গা উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আইয়ুব হোসেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহবায়ক জিল্লুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য সাবেক হারদী ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর উত্তরের দারুস সালাম থানা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক মোমিন চৌধুরী ডাবু ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ব্যবসাযী কে এম মঞ্জিলুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যদিও এ উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নেই। যার কারণে শুধু আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা এই উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে রেষারেষিতে ব্যস্ত।